আক্রান্তের সংখ্যা অর্ধলক্ষ : ডেঙ্গুর ভয় আরও এক মাস
Published on Saturday, August 17, 2019 at 1:09 pm
এমসি ডেস্ক: ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত দুই সন্তানকে নিয়ে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দিন কাটাচ্ছেন বাসাবোর মো. আশরাফ উদ্দিন বাবুল। তিনি জানান, প্রায় এক সপ্তাহ আগে জ্বরসহ নানা অসুস্থতায় আক্রান্ত হয় ১৪ বছর বয়সী সন্তান সাজিদ।
পরীক্ষা করে জানা যায়, মেয়েটিও ডেঙ্গু আক্রান্ত। সেই রাতে তাকেও হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এখন মেয়ে ৮ তলায় এবং ছেলে ১০ তলায় চিকিৎসাধীন।
শুধু আশরাফ উদ্দিনের ক্ষেত্রে নয়, এমন চিত্র রাজধানীসহ সারা দেশের অনেক বাড়িতেই। সরকারি হিসাবে গত ২৪ ঘণ্টায় (বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা) দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন ১৭১৪ জন।
আর শনিবারে নতুন করে আরও দু’জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় অর্ধলক্ষ (৪৯৯৯৯) রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৪০ জনের।
যদিও বেসরকারি হিসাবে শুধু আগস্ট মাসেই ৬৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সারা দেশে ডেঙ্গুর যে বিস্তার ঘটেছে তার প্রকোপ থাকবে আরও অন্তত এক মাস।
আগামী সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ ডেঙ্গুর চলমান পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলে আশাবাদ তাদের। তবে আবহাওয়া অপরিবর্তিত থাকলে এবং কার্যকর মশা নিধন অভিযান পরিচালনা করা না হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগতে পারে বলেও জানান তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮ সালে যেমন রাজধানীর এমন পরিবার ছিল না, যে পরিবারের কেউ না কেউ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়নি, তেমনি এ বছর ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে অনেকটা একই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
গত ১৯ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যাবে, গত ১৮ বছরে সারা দেশে যে পরিমাণ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে চলতি বছরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তার চেয়ে বেশি।
এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমি মনে করি ডেঙ্গুর এ প্রকোপ আরও এক মাস থাকতে পারে। তবে আসছে সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করবে।
আমাদের দেশে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা আগেই শুরু হয়েছে। জুলাই-আগস্ট মাসে এর প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেপ্টেম্বরে এর প্রকোপ কমতে শুরু করবে।
একই ধরনের মন্তব্য করেন বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর চৌধুরী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, গত ৫ বছরের হিসাবে বেশির ভাগ সময় (৩ বছর) সেপ্টেম্বর মাসেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
তাই আমি মনে করি এ বছরও এর ব্যতিক্রম হবে না। তিনি বলেন, তবে যেহেতু থেমে থেমে বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে তাই নিয়মিতভাবে সোর্স রিডাকশন, লার্ভা কন্ট্রোল করতে হবে।
শুধু আবহাওয়ার ওপর ডেঙ্গুর প্রকোপ হ্রাস-বৃদ্ধি নির্ভর করে না। থেমে থেমে বৃষ্টি অবশ্যই মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করে। তাই সেগুলো ধ্বংসের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
ড. মঞ্জুর বলেন, বর্তমান সময়ে যে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে সেটি হল গ্রামে ঈদ করে যারা ঢাকায় ফিরছেন, তাদের ঘরে প্রবেশের আগে অবশ্যই মশক নিধন ওষুধ স্প্রে করতে হবে।
আর ঈদের ছুটির পর যেসব স্কুল-কলেজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে, খোলার আগেই সেসব প্রতিষ্ঠানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করতে হবে এবং পর্যাপ্ত ফগিং করতে হবে। তাহলে নতুন করে আক্রান্তের হার কমানো সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার জানান, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৪৯ হাজার ৯৯৯ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এর মধ্যে ছাড়পত্র নিয়ে ঘরে ফিরেছেন ৪২ হাজার ২৪৩ জন। শতকরা হিসাবে এই হার ৮৪ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ১৭১৪ জন।
এর মধ্যে ঢাকায় নতুন রোগীর সংখ্যা ৭৫৯ জন এবং ঢাকার বাইরে ৯৬০ জন।
এই তথ্য ৬৪ জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়, রাজধানীর ৩০টি বেসরকারি এবং ১০ সরকারি হাসপাতালের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি। তবে প্রকৃত আক্রান্ত, ভর্তি এবং মৃতের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
কন্ট্রোল রুমের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরে এ পর্যন্ত অর্ধলক্ষ রোগী হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু আগস্টের ১৬ দিনেই ভর্তি হয়েছেন ৩১ হাজার ৫৩৮ জন। এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের।
এছাড়া গত জুলাই মাসে ভর্তি হয়েছেন ১৬ হাজার ২৫৩ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২৪ জনের। জুন মাসে ভর্তি হন ১৮৮৪ জন এবং মৃত্যু হয় ৪ জনের, মে মাসে ১৯৩ জন ভর্তি হলেও কোনো মৃত্যুর ঘটনা নেই।
তবে গত এপ্রিল মাসে ৫৮ জন ভর্তি হন এবং ২ জনের মৃত্যু ঘটে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, একটি বা দুটি প্যারামিটারের ওপর ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়া নির্ভর করে না। তবে আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
দু’জনের মৃত্যু : শুক্রবার রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরও দু’জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছে। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে কহিনুর বেগম (৩২) নামে একজন আইসিইউতে মারা গেছেন।
এ ছাড়া বেলা ২টা নাগাদ দক্ষিণ খিলগাঁও থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা মো. আবদুল মান্নান (৬০) ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
মৃত আবদুল মান্নানের মেয়ে জামাই ফয়েজ আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ঈদের একদিন আগে এই হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।
পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ায় এখানে চিকিৎসা নিতে ভর্তি করানো হয়েছিল। চিকিৎসাও চলছিল। কিছুক্ষণ পরপর ডাক্তারও এসে দেখে যাচ্ছিল। তিনি বলেন, শুক্রবার মারা যাওয়ার পাঁচ মিনিট আগে প্রস্রাব করাতেও নিয়ে গেছি।
এসে সবার দিকে একবার তাকিয়েছে, কথাও বলেছে। তবে হঠাৎ করে আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। পরে ডাক্তার ডাকা হলে মৃত ঘোষণা করেন।
ঢাকার বাইরের চিত্র : যুগান্তরের বিভিন্ন ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে দেখা যায়, দেশের নানা এলাকায় প্রতিদিনই নতুন করে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে।
শেরপুর প্রতিনিধি জানান, সেখানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শেরপুর জেলা সদর হাসপাতালে আরও ৫ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে।
সিলেটে ডেঙ্গু আক্রান্তরা ক্রমেই সুস্থ হয়ে উঠলেও এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। গতকাল শুক্রবার ২৪ ঘণ্টায় সিলেট ওসমানী হাসপাতালে আরও ৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এর বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরও ২ জন রোগী।
চট্টগ্রামে শুক্রবার পর্যন্ত ৭১৫ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এই সংখ্যা ইতিমধ্যে চারগুণ ছাড়িয়েছে। ঈদের ছুটিতে ঢাকায় বসবাসরত অনেকে চট্টগ্রামে আসায় ডেঙ্গু রোগী হুড়হুড় করে বাড়ছে।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী যুগান্তরকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে ইতিমধ্যে ৭১৫ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।
এর মধ্যে উপজেলা ও নগরীর বেসরকারি হাসপাতালে ২৪১ জন এবং বাকিরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
সংযুক্তিতে থাকা ১২৬ জনের মানবেতর অবস্থা : রাজধানীর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সারা দেশের ১২৬ জন স্যানিটারি ইন্সপেক্টরকে দুই সিটি কর্পোরেশনে সংযুক্ত করা হয়েছে। গত ২৯ জুলাই সংযুক্ত করা হলেও তাদের নেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা।
এমনকি রাজধানীতে কার্যক্রম পরিচালনায় তাদের দেয়া হচ্ছে না কোনো অর্থ। এই স্বল্পবেতনভুক্ত মানুষগুলোকে হোটেলে বা বাসা ভাড়া করে থাকতে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। যুগান্তরে ফোন করে এমন তথ্য জানিয়েছেন তারা।
এক কথায় সরকারের নির্দেশে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকার পথে পথে ঘুরছেন। ইতিমধ্যেই এমন অবহেলার শিকার হয়ে প্রতিরোধ সেলের একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
জানা গেছে, ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রমে অংশ নিতে তিন বছরের এসআইটি (স্যানিটারি ইন্সপেক্টরশিপ ট্রেনিং) ডিপ্লোমাধারী দেশের ১২৬ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে সংযুক্ত করা হয়েছে।
এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ৭২ জন এবং উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ৫৪ জনকে সংযুক্ত করা হয়েছে।
গত ২৯ জুলাই বিকালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শহিদ মো. সাদিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত পৃথক দুটি সংযুক্তি আদেশে বলা হয়, এ আদেশ জনস্বার্থে জারি করা হল।
পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রমে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে সংযুক্তিতে ন্যস্ত করা হল।
আদেশপ্রাপ্ত কর্মচারীরা ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে সংযুক্তিকৃত কর্মস্থলে যোগদান করবেন। অন্যথায় তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি থেকে অব্যাহতি পায়েছেন বলে গণ্য হবেন।
Leave a Reply